বিশ্বব্যাংকের ‘আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন ২০২৪’-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গত বছর বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়ে গেছে ৯০ শতাংশ, যা বৈশ্বিকভাবে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে নতুন ঋণ ছাড়ের পরিমাণ কমে যাওয়ায় নিট ঋণও সংকুচিত হচ্ছে। ঋণের সুদহার বৃদ্ধি এবং গ্রেস পিরিয়ড কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় আরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০২৩ সালে ১০ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ২০১০ সালে এই স্থিতি ছিল মাত্র ২ হাজার ৬৫৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩ সালে ১৭২ কোটি ১০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৬ শতাংশ বেশি। একই সময়ে স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধও ২৪ শতাংশ বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক ঋণের সুদহার ৪-৫ শতাংশ থেকে বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৭-৮ শতাংশে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে ডলার সংকটের কারণে বেশ কিছু ঋণের কিস্তি স্থগিত করতে হয়েছে, যার ফলে দণ্ড সুদের বোঝাও বেড়েছে।
বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধের হার কিছুটা কমলেও সরকারি খাতে ঋণ পরিশোধের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে সরকারি গ্যারান্টিতে নেওয়া ঋণের স্থিতি ৭ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। সরকারি প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়লেও নতুন ঋণ ছাড়ের পরিমাণ কমেছে।
- ২০২২ সালে নতুন ঋণ ছাড় করা হয়েছিল ১ হাজার ৩৩৮ কোটি ডলার, যা ২০২৩ সালে কমে ১ হাজার ২৮৪ কোটি ডলারে নেমে এ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এবং ভারত বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে রয়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপালের তুলনায় বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ কম হলেও সুদ পরিশোধের হার দ্রুত বাড়ছে।
শ্রীলংকা, যা ২০২২ সালে দেউলিয়া হয়েছিল, বর্তমানে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দেশটির ঋণের স্থিতি জিএনআইয়ের ৭৬ শতাংশ, যা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে তাদের ঋণ পরিশোধের হার জিএনআইয়ের ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের ঋণের স্থিতি ১৩ হাজার ৮৫ কোটি ডলার, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধের হার ৪৩৩ কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনটি কিছু সুসংবাদের কথাও জানিয়েছে। বৈদেশিক ঋণের ৫৪ শতাংশই বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে নেওয়া, যেখানে সুদের হার কম এবং মেয়াদ দীর্ঘ। মোট বৈদেশিক ঋণের ২২ শতাংশ জাতীয় জিডিপির বিপরীতে। এ হার অর্ধেকের বেশি হলে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। জিএনআইয়ের বিপরীতে ঋণ শোধের হার মাত্র ২ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণের প্রবাহ কমে এসেছে। দীর্ঘমেয়াদি ও কম সুদের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
২০০৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলোর সময়ে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ঋণের একটি বড় অংশ লুটপাট এবং বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বর্তমান সরকারকে এই ঋণের দায়ভার নিতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিকভাবে ২০২৩ সালে ৩৫ শতাংশ দেশ বেশি ঋণ নেওয়ার ফলে উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঋণের ঝুঁকি তুলনামূলক কম হলেও সুদ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান চাপ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বৈদেশিক ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশকে কঠিন এক বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়েছে। সুদ পরিশোধের উচ্চ হার এবং নতুন ঋণ ছাড়ের সংকোচন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলতে পারে। সঠিক ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকর নীতি গ্রহণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।