বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বসবাসের অভিযোগে ইতালি, অস্ট্রিয়া, গ্রিস ও সাইপ্রাস থেকে ৫২ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে চার্টার্ড ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম দফায় ৩২ জনের পৌঁছানোর কথা রয়েছে। ফেরত পাঠানো সবাই পুরুষ। বাকি ২০ জনকে কবে পাঠানো হবে, সেই দিনক্ষণ এখনও জানা যায়নি।
বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কয়েক দিন ধরেই চিঠি চালাচালি করেছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এর আগে কয়েক দফায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর কড়া অভিবাসন নীতি গ্রহণ করে। ২০২৪ সালের শুরু থেকে এই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশির সংখ্যা অন্তত ১৮৭। ইমিগ্রেশন পুলিশের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, ইউরোপ থেকে যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, এরই মধ্যে তাদের নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট নম্বরসহ যাবতীয় তথ্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বিমানবন্দরে তাদের গ্রহণ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধভাবে যারা ইউরোপে প্রবেশ করছে, তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। ফেরত আসাদের তালিকায় যারা আছেন, তাদের বৈধ কাগজপত্র নেই।
ইউরোপের সীমান্ত রক্ষাবাহিনী ও কোস্টগার্ড এজেন্সি ‘ফ্রন্টেক্স’ নামে পরিচিতি। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যারা ইউরোপে বাস করেন, তাদের নিজ দেশে ফেরাতে কাজ করে ফ্রন্টেক্স। বাংলাদেশে ফেরত আসার পর বিমানবন্দরে তাদের গ্রহণ, আর্থিক সহায়তা ও পরে কাউন্সেলিং করানোর কাজ করে আসছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক।
ইউরোপ থেকে আসা এই ফ্লাইটের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। সমকালকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অনিয়মিত অভিবাসনকে উৎসাহিত করে না। এ কারণেই বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এসওপি) সই করেছে। এর আওতায় যারা বাংলাদেশে আসে, তাদের কল্যাণ এবং টেকসই পুনরেকত্রীকরণে কাউন্সেলিং ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ফ্রন্টেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে ব্র্যাক। নতুন করে কেউ এলে তারাও সেই সহায়তা পাবেন। তবে অনিয়মিত অভিবাসন বা সাগরপথে বিদেশে যাওয়া থেকে সবার বিরত থাকা উচিত।
বিমানবন্দর ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করছেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, গত ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সি-১৭ সামরিক উড়োজাহাজে এক নারীসহ ৩৯ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়। এ বছরের ৮ জুন একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়। ৬ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত একাধিক ফ্লাইটে আরও ৩৪ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
শুরুতে যেসব বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা হয়। হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়নি। তবে শেষ দুই ধাপে যারা ফেরত এসেছেন, তাদের হাতকড়া ও শিকল পরানো হয়েছিল। ফ্লাইটে কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা সমকালকে জানিয়েছেন অনেকে।
ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার পথটি বেছে নেন। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই পথে অন্তত ৭০ হাজার ৯০৬ বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেন। এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
২০২৪ সালে ব্র্যাকের এক গবেষণায় উঠে আসে, এক দশক ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়া লোকজনের মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ২৫ লাখ মানুষ এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গেছেন। এভাবে যেতে গিয়ে প্রায় ২২ হাজার মানুষ সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অনেক বাংলাদেশি আছেন।
ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোক সবচেয়ে বেশি। তাদের অধিকাংশের বাড়ি মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায়।