ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে ‘১২ দিনের সংঘাত’ গোটা বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। এই সংঘাত শুধু ইরানের সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্যই নয়, বরং দেশটির শাসনব্যবস্থা, নিরাপত্তা কাঠামো, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং কৌশলগত অভিমুখের জন্যও ছিল এক জটিল পরীক্ষা।
তবে বাস্তবে দেখা গেছে, ইসরায়েলের হামলাগুলো ঠিক সেই এলাকাগুলোকেই লক্ষ্য করে হয়েছে, যা ইরানের কথিত প্রতিরক্ষা সক্ষমতার বাস্তবতার সঙ্গে অমিলের প্রমাণ দেয়। বিশ্লেষকরা একে ‘আত্মবিভ্রম’ বলে অভিহিত করেছেন।
কেবল প্রতিরক্ষা নয়, এই সংঘাত ইরানের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামোর গভীরে শত্রুপক্ষের অনুপ্রবেশের বিষয়টিও সামনে এনেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ইরানের সামরিক মহড়ার সংবেদনশীল তথ্য, টার্গেটের স্থানাঙ্ক এবং নিরাপত্তা পরিকল্পনা সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে।
ফলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, ক্ষেপণাস্ত্র কমান্ড এবং প্রতিরক্ষা কেন্দ্রগুলোর মতো স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে কর্মরত ব্যক্তিদের বিশ্বস্ততা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুদ্ধি অভিযান ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা সম্ভবত শাসকগোষ্ঠীর ভেতর বিদ্যমান ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তুলবে।
আক্রমণাত্মক শক্তি ও জাতীয় ঐক্য প্রতিরক্ষাগত দুর্বলতা সত্ত্বেও ইরান এই সংঘাতে তার আক্রমণাত্মক সক্ষমতা বিশেষ করে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার দেখিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েলে এসব অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক প্রভাব ইরানের অপ্রচলিত সামরিক শক্তিকে আবারও সামনে এনেছে।
ফলে ইরান শুধু প্রতিরক্ষামূলক নয় বরং একটি আক্রমণাত্মক ও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
অনেকের ধারণা ছিল, এমন একটি যুদ্ধ দেশটিতে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, শাসনব্যবস্থার পতন অথবা জাতিগত বিদ্রোহ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কুর্দি, বেলুচি, আরব ও আজেরি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ দেখা যায়নি।
জনগণও স্থিতিশীলতাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এটি বোঝায় যে, ইরানের সমাজে এখনো শাসকের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বজায় আছে এবং জনগণ বাইরের হামলার মুখে জাতীয় ঐক্য দেখিয়েছে।
ইরান কী আশা করছে?
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইরানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, দেশটি কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবে। তিনটি পথ সামনে রয়েছে:
১. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় আলোচনায় বসে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়া,
২. আরও কট্টর অবস্থান নিয়ে পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করা,
৩. কিংবা অনিশ্চয়তার মধ্যে কৌশলগত নমনীয়তা বজায় রাখা।তবে, যুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করাকে অনেক ইরানিই ‘অমর্যাদাকর’ বলে মনে করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে বিশ্বাস করার মানসিকতাও দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে আপসহীন অবস্থান ও প্রতিরোধের প্রবণতা আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
ইরানের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন ও ক্ষমতার ভারসাম্যের রদবদল হতে পারে। বিপুল মাত্রার অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগে বিপ্লবী গার্ডসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি শুরু হয়েছে।
এই শুদ্ধি অভিযান শুধু নিরাপত্তা খাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা ইরানের সামগ্রিক রাষ্ট্র কাঠামো ও অভিজাত গোষ্ঠীর ক্ষমতার ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করবে।
১২ দিনের এই সংঘাত ইরানের জন্য এক বহুস্তরীয় পরীক্ষা ছিল, যা একদিকে প্রতিরক্ষার দুর্বলতা, অন্যদিকে আক্রমণের সক্ষমতা ও সামাজিক ঐক্যের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছে।
ইরান এখন যে সিদ্ধান্ত নেবে—সংস্কার বা দমন, আপস বা প্রতিরোধ —তা শুধু দেশের ভবিষ্যৎ নয়, গোটা অঞ্চলের গতিপথ নির্ধারণে সহায়ক হবে।